বিংশ শতাব্দির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারী, ও বিশিষ্ট লেখক শায়েখ সিদ্দিক আল-মিনশাবী। বিশ শতকে মুসলিম বিশ্বে যে কয়টি রত্ন জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে শায়েখ মিনশাবীর নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তাঁর কোরআনের তেলাওয়াত মুগ্ধ করেছে সবাইকে। তাঁর তাজবীদ বিশ্বের কোরআন বিশ্লেষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। পৃথিবীর আনাচে কানাচে তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন এই অপার্থিব সুর। আজও রাষ্ট্রের সীমানা ও সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে তাঁর কন্ঠ কিংবদন্তি হয়ে বাঁজছে মুসলমানের ঘরে।
প্রাথমিক জীবন
শায়েখ সিদ্দিক আল-মিনশাবী ১৯১৯ অথবা ২০ সালের ২০ জানুয়ারি মিশরে জন্মগ্রহন করেন। কায়রো থেকে দক্ষিন দিকে সোহাজ জেলায়। মিনশাবীর বাবাও ছিলেন কারী। বলা যায়, কেরাতের প্রতি ভালবাসাটা পেয়েছেন পারিবারিক সুত্রেই। বাবার ইচ্ছাতেই শুরু করলেন কেরাত শিক্ষা ও অধ্যাবসায়। উত্তোরত্তর উন্নতি হতে থাকলে তরুণ বয়সে এসে তিনি হাজির হন বিশিষ্ট কারী শায়েখ ইব্রাহীম আস-সৌদির কাছে। শায়েখ আস-সৌদি ছিলেন কেরাতের তাজবীদ, নিয়ম কানুন ও কলা-কৌশলের উপর বিশেষ দক্ষতার অধিকারী। মিনশাবী তার কাছে কিরাত শিখতে থাকেন। এবং সেই তরুণ বয়সেই তিনি তার প্রথম কেরাতের রেকর্ড প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞ সমালোচক ও শ্রোতাদের মাঝে আলোড়ন তুলে ফেলেন।
বিবিধ অনুষঙ্গ
শায়েখ মিনশাবী ছিলেন অত্যান্ত ব্যক্তিত্ব সচেতন ও আত্মাভিমানী মানুষ। কোরআনের শ্রদ্ধার প্রতি সদা সতর্ক ছিলেন। আল্লাহর কালামকে কোথাও ছোট হতে দেন নি। এবং কোরআনের মাধ্যমে কখনো পার্থিব অর্থবিত্ত, যশ-খ্যাতি অর্জনের চেষ্টায় লিপ্ত হন নাই। প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরের সময়ের কথা, একদা জামাল আব্দুন নাসের তাকে রাজসভায় তেলাওয়াতের জন্য আহবান করেন। প্রেসিডেন্টের দূত হয়ে একজন মন্ত্রী এসেছিলেন শায়েখের কাছে। শায়েখ ব্যক্তিগত অপছন্দ থেকে অসম্মতি জানান। মন্ত্রী বললেন, যেখানে জামাল আব্দুন নাসের আপনার কোরআন শোনার জন্য বসে থাকবেন, সেখানে যাওয়াটাই আপনার জন্য সম্মানজনক হবে। ”
শায়েখ বিরক্ত হয়ে বললেন, কোরআনের সম্মানে মিনশাবীর বাসায় এসে তেলাওয়াত শুনে যাওয়াটা কেন জামালের জন্য সম্মানজনক নয়?
মন্ত্রী ফিরে গেলেন। মিনশাবীও আর কখনই রাজসভায় গেলেন না। পরবর্তীতে লোকজন জিজ্ঞাসা করেছিল শায়েখকে, আপনি কেন গেলেন না!
শায়েখ বলেছিলেন, জামাল আব্দুন নাসের অভদ্র লোক পাঠিয়েছিল, তাই যাইনি।
মিশরের জাতীয় রেডিওতে কোরআন তেলাওয়াতের জন্য আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল শায়েখ মিনশাবীকে। তিনি সেটাও প্রত্যাখ্যান করেছেন। পার্থিব কোন লাভ ক্ষতির খতিয়ানকে তিনি কোরআনের মুখোমুখি করেননি। রেডিওকে বলে দিয়েছেন, আমার খ্যাতির প্রয়োজন নেই, তাই রেডিওতে তেলাওয়াতেরও প্রয়োজন নেই৷
কিন্তু রেডিও কর্মকর্তারা ছিল নাছোড়বান্দা। বহুদিন তার অনুরোধ করেও যখন কাজ হয়নি, তখন তারা রমজান মাসের অপেক্ষা করতে থাকে। শায়েখ তার গ্রামের যেই মসজিদটিতে তারাবীর নামাজ পড়াতেন, তারা সেখান থেকে তেলাওয়াত রেকর্ড করে তা রেডিওতে প্রচার করে।
শুধু কোরআন তেলাওয়াতই নয়, তিনি লেখালেখিও করতেন৷ ইতিহাস ও তাজবীদের উপর কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। পেইন্টিংয়ের কাজও জানতেন দক্ষ লোকের মত। ক্যালিওগ্রাফি ছিল তার পছন্দের কাজ৷ কোরআনের আয়াত দিয়ে অনেক ক্যালিওগ্রাফি করেছেন। আন্তর্জাতিক ” ওয়ার্ল্ড অফ ইসলাম ফেস্টিভালে ” তিনি বেশ কিছু সুন্দর ক্যালিওগ্রাফি উপহার দেন।
ব্যাক্তিগত জীবন
শায়েখ মিনশাবী তার ব্যক্তিগত জীবনে দুইটি বিবাহ করেন। চারজন পুত্র সন্তান এবং দুইজন কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। সহজ সরল জীবন যাপন যাপন করতেন। শহরমুখিতা পছন্দ ছিল না তার। সুযোগ থাকতেও কায়রো আসেন নি। শহরতলিতেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। অনেকগুলি দেশ ভ্রমন করেছেন। শিশুদেরকে কোরআন শিক্ষা দেয়া ছিল তার নেশার মত। শেষেরদিকে এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন অনেক। কেরাতের অনুষ্ঠানে খুব কম যোগ দিতেন। পড়ে থাকতেন বাচ্চাদের নিয়ে।
গতানুগতিক কারীদের জীবন যাপন দেখলে শায়েখ মিনশাবীকে অনুমান করা যায়না। খ্যাতি, অর্থবিত্তের চুড়ায় থাকার সম্ভাবনা থেকেও তিনি নিজেকে কেবল আড়াল করতেই চেয়েছেন। ফলত, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁকে উঁচু থেকে উঁচুতর করেছেন। পৃথিবীর কোরআন শিক্ষার সকল মারকাজে আজও তার নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয়।
ইন্তেকাল
১৯৬৯ সালের ২০ জুন কোরআনের পাখি শায়েখ সিদ্দিক আল মিনশাবী ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের সময় তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৯ বছর।
ইয়া রাব্বি আপনি এই কোরআনের পাখি কে জান্নাতের সু উচ্চ মাকাম দান করেন।আমিন